শাহীন মাহমুদ রাসেল :: চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের সব চেয়ে বড় গরুর বাজার খ্যাত কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া বাজারে ইজারা আদায়ের নামে চলছে লুটপাট। কালের পরিক্রমায় বাজারটির ইজারামূল্য এতো বেশি বেড়েছে যে কারণে লোভাতুর দৃষ্টি পড়েছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রের। এমনকি ষড়যন্ত্র করে অতি সুক্ষ্ম কৌশল খাটিয়ে বাজারটির ইজারা যোগ্যতাও নস্যাত করা হয়েছে। ফলে- ইজারা যোগ্যতা নষ্ট করে ফেলায় বাজারটি এখন উপজেলা প্রশাসনের হাতছাড়া হয়ে গেছে। অন্যদিকে নিয়ম অনুযায়ী আড়াই কোটি টাকার বাজারটি এখন সদর ভূমি অফিসের অধীনে নাম মাত্র মূল্যে খাস কালকেশনে নিয়ে লুটপাট করারও বন্দোবস্ত করা হয়েছে। খাস আদায়ে ভূমি অফিসের লোকদের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাদের হাতে নেই বাজারের ন্যুনতম নিয়ন্ত্রণ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, একজন যুবলীগ কর্মী, আওয়ামীলীগ নেতা ও জামায়াত নেতারা মিলেমিশে একাকার হয়ে একটি সিন্ডিকেট করে তাদের পকেটে ঢুকিয়ে নিচ্ছে সরকারি রাজস্বের কোটি কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে খাস কালেকশনের টাকা সরকারি কোষাগারে যতসামান্যও জমা পড়ছে কীনা তা নিয়ে সচেতন মহলে দেখা দিয়েছে সংশয়।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, প্রশাসনই ওইসব নেতা এবং সিন্ডিকেটকে এই সুযোগ করে দিয়েছে। এদিকে, এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও গত বুধবার (১৬ ডিসেম্বর) হাটের দিন সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, যুবলীগকর্মী ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা ইজারা আদায়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন। তা ছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাবেক শিবির ক্যাডার ও জামায়াতের নাশকতা মামলার আসামীসহ অনেক নেতা-কর্মীই কেউ ক্যাশ কাউন্টারে, আবার কেউ বা গরুর হাটে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করছেন।
খাস আদায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সদর ভূমি অফিসের তহসিলদার মো: সাহেদ কোনদিন বাজারে যাওয়া তো দুরে থাক; বাজারটি সম্পর্কে তার নুন্যতম ধারণা নেই বলে সচেতন মহলের অভিযোগ। বিষয়টি তার নজরে আনা হলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, প্রশাসনে লোকবলের অভাব রয়েছে। একারণে কতিপয় যুবক সরকারী কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে- তারাই সিন্ডিকেট করে বাজারটি থেকে কোটি টাকা কালেকশন করে ভোগ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে তারা বাজার থেকে যে টাকা উত্তোলন করে সে অনুপাতে খুব সামান্য টাকাও জমা দিতে তারা অনীহা প্রদর্শন করছে। তাদেরকে সরকারের ন্যায্য পাওয়ানা বুঝিয়ে দিতে একাধিক তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এরপরও তারা সরকারের খাস কালেকশনের ন্যায্য টাকা কাগজপত্রসহ বুঝিয়ে দিচ্ছে না। একারণে তাদের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো টাকা গ্রহণও করা হয়নি বলে জানান তহসিলদার সাহেদ। ন্যায্য খাস আদায়ে তার অবহেলা রয়েছে কীনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি উপজেলা প্রশাসনের উপর দায় চাপিয়ে কৌশলে এড়িয়ে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়- চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের সব চেয়ে বড় গরুর হাট হিসেবে পরিচিত খরুলিয়া বাজার। গত বছর এই বাজারের ডাক উঠেছিল দুই কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এ বছরে আড়াই কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারত বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। সরকার দলীয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ইন্ধনে উপজেলা ও ভূমি প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজসে পরিকল্পিত ভাবে চলতি সনে বাজারটির দরপত্র সংগ্রহকারীদের কেউই আবেদনপত্র জমা দেননি। যার ফলে বাজারটি ইজারাদার বঞ্চিত হওয়ায় সরকার বঞ্চিত হচ্ছে আড়াই কোটি টাকার রাজস্ব থেকে। এভাবেই একটি প্রতিষ্ঠিত বাজারের ইজারা ডাক নষ্ট করে দিয়ে ভূমি অফিসের অধীনে খাস কালেকশনে নিতে বাধ্য করেছে চক্রটি। পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক উপজেলা প্রশাসন ভূমি অফিসের উপর বাজারটির খাস কালেকশনের দায়িত্ব দিয়ে আপাতত পার পাওয়ার সুযোগ নিলেও বাস্তবতা হলো লোকবল সংকট, এবং খরুলিয়া বাজার ঘিরে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটের লুটপাটের কারণে ওই খাস কালেকশনও আদায় হচ্ছে না ঠিক মতো। গত ৬ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো ইজারা কালেকশনের কাজ করে যাচ্ছে ওই সিন্ডিকেটের লোকজন।
সচেতন মহল জানান, প্রশাসনের সহযোগিতায় বাজার সিন্ডিকেটের লোকজন বেআইনিভাবে খাস আদায়ের নামে লুটপাট করছে। তারা আরো জানান, প্রতি রবিবার-বুধবার এখানে হাট বসে। বাজারের সাবেক এক ইজারাদার জানান, তার সময়ে প্রতি হাটে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা কালেকশন হতো। এখনো তা-ই হচ্ছে। শুধু তাই নয়, পূর্বের ইজারা আদায় পদ্ধতি এবং পরিস্থিতির সম্পর্কে জ্ঞাত থাকায় ব্যবসায়ীদের উপর চাপ প্রয়োগ করে জোর পূর্বক ইজারা সমপরিমাণ অর্থ আদায় করে নিচ্ছে খাস আদায়ের নামে নিয়োজিত এই সিন্ডিকেটটি। সর্বশেষ চলতি সনের কোরবানীর ঈদে গরুর বাজার হতে কমপক্ষে ৪৫ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। ইজারা থেকে খাসে যাওয়ায় বাজার সুবিধাভোগী ক্রেতা বিক্রেতা আশা করেছিলেন এবার হয়তো টোলের বোঝা একটু কমবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আরও বিপদ। অনেকেই আক্ষেপ করে জানান- এটি শাখের করাতের মতো। যেদিকেই হউক সাধারণ জনগণকেই টোলের বোঝা বয়ে যেতে হবে। তবে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে একটি চক্র যেভাবে কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে সেটিও ঘৃণার দৃষ্টিতে প্রতক্ষ করছেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, যৌক্তিক কোন কারন ছাড়াই খরুলিয়া বাজারটি খাস আদায়ের নামে টোলের টাকা লুটপাট করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় আওয়ামীলীগের কয়েকজন ও জামায়াতের প্রভাবশালী নেতারা হাটটি ইজারা প্রদানে বাঁধা হয়ে আছেন।
প্রশাসনের সহযোগিতায় সরকারের মোটা অঙ্কের এই রাজস্ব ফাঁকির ঘটনায় স্থানীয় বৃদ্ধ মো করিম ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাঘডাশে।
এদিকে খরুলিয়া হাটবাজার নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে সেসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে সদর ভূমি কর্মকর্তা (সহকারী কমিশনার) মং মারমা জানান- তিনি নতুন এসেছেন। একারণে বিস্তারিত জানেন না। এবং এবিষয়ে সাংবাদিকদের কোনো কিছু জানার থাকলে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে জেনে নিতেও পরামর্শ দেন।
বিষয়টি ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সায়রাত-১) তাজুল ইসলাম মিয়ার নজরে আনা হলে তিনি প্রতিবেদককে জানান- এধরণের কোনো বিষয়ে এর আগে কেউ আমাদের জানায়নি। একারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এখন জেনেছি। খোঁজ খবর নিয়ে যথাযত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাঠকের মতামত: